ঘড়িয়াল

ঘড়িয়াল হলো এক বিরল প্রজাতির মিঠাপানির শান্ত প্রকৃতির কুমির। ইংরেজিতে একে Gharial বা Gavial বলে। এটি Reptilia শ্রেণীর Gavilidae গোত্রের লম্বা তুন্ড (Snlout) বিশিষ্ট জলচর প্রাণী। এর বৈঞ্জানিক নাম Gavialis gangeticus । বাংলাদেশে এটি ঘড়িয়াল, ঘাড়েল, বাইশাল, মেছো কুমির, ঘট কুমির প্রভৃতি নামেও পরিচিত। এ ছাড়া এদের লম্বা-নাক কুমির, নাকা, নাকার ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। পুরুষ ঘড়িয়ালের ওপরের চোয়ালে নাকের ঠিক ওপরে কলস বা ঘড়া আকৃতির একটি পিন্ড থাকে। এ কারণেই সম্ভবত একে ঘড়িয়াল নামে ডাকা হয়ে থাকে। একসময় বাংলাদেশসহ আমাদের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ যেমন ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্থান ও মিয়ানমারে এই প্রাণিটির ব্যাপক দেখা যেত। প্রাকৃতিক পরিবেশে সমগ্র পৃথিবীতে বর্তমানে ২৩৫ টির মতো বুনো ঘড়িয়াল রয়েছে। বর্তমানে এটি বিপন্ন প্রাণী হিসেবে IUCN-এর Red Data Book-এ স্থান করে নিয়েছে। এরা স্বাভাবিকভাবে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ বছর বাঁচলেও মানুষের আগ্রাসনের কারণে এরা এখন বিলুপ্তির পথে।লেজের মাথা থেকে বর্ধিত চোয়ালের অগ্রভাগ পর্যন্ত একটি ঘড়িয়াল সর্বাধিক ৬ মিটার (২০ ফুট) পর্যন্ত লম্বা এবং ওজনে ১৬০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারণত বয়স্ক পুরুষ ঘড়িয়াল ৫ থেকে ৬ মিটার এবং মেয়ে ঘড়িয়াল ৩.৫ থেকে ৪.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। বাচ্চা ঘড়িয়ালের রঙ বয়স্কদের চেয়ে উজ্জ্বল। বয়স্করা কালচে ধূসর। বাচ্চা ঘড়িয়াল জন্মের সময় ২৫-৩০ সেঃমিঃ লম্বা থাকে।পুরুষ ঘড়িয়াল সাধারনত ১২-১৩ বৎসরে (৩ মিটার) এবং স্ত্রী ঘড়িয়াল ১০ বৎসরে (২.৭ মিটার) প্রজননক্ষম হয়। মার্চ ও এপ্রিল মাস ঘড়িয়ালের প্রজনন ঋতু। এ সময়ে মা ঘড়িয়াল নদীর বালিয়াড়িতে ডিম পেড়ে বালি দিয়ে ঢেকে রাখে। এরা একসঙ্গে ২০ থেকে ৯৫ টি ডিম পাড়ে। এরা কচ্ছপ এবং কুমিরের মতোই ডিম ফোটায়। ৭১ থেকে ৯৩ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। সদ্যজাত বাচ্চারা শুঁড়সহ ২২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।প্রাপ্ত বয়স্ক ঘড়িয়াল খাদ্য হিসেবে প্রধানত মাছ বিশেষ করে বোয়াল, আইড়, গুঁজি, পাঙাশ বেশি পছন্দ করে তবে এরা খাদ্য হিসেবে ব্যাঙ ও কীটপতঙ্গও গ্রহণ করতে পারে। শিশু ঘড়িয়াল বিভিন্ন ধরনের অমেরুদন্ডী প্রাণী যেমন কীটপতঙ্গ এবং ছোট আকারে ব্যাঙ খেয়ে থাকে। শিকারি পাখি, কুমির এবং বোয়াল জাতীয় রাক্ষুসে মাছ ঘড়িয়াল ছানা খেয়ে ফেলে।এক সময় পদ্মা ও যমুনা নদীতে প্রচুর ঘড়িয়ালের আনাগোনা ছিল। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধ ও জলজ পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এদের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। বর্তমানে রাজশাহী শহর সংলগ্ন পদ্মা নদীতে মাঝে মধ্যে দেখা মেলে বলে জানা গেছে। তবে এদের বিচরণ ক্ষেত্র রাজশাহী হতে আরিচা এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু বর্তমানে ঘড়িয়াল দেশে বিলুপ্তপ্রায় মহাবিপদাপন্ন সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর মধ্যে অন্যতম।ঘড়িয়াল বাঁচানোর জন্য সরকারীভাবে এখন পর্যন্ত কোন রকম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। নির্বিচারে হত্যা, সরকারের উদাসীনতা এবং শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকার কারণকে ঘড়িয়াল বিলুপ্তির প্রধান কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়ে থাকে। অথচ দেশের নদীগুলো এখনও ঘড়িয়াল টিকে থাকার জন্য উপযোগী। ঘড়িয়াল রক্ষার জন্য সরকারকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। তাই এই মুহূর্তে ‘ঘড়িয়াল অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করা খুবই জরুরী। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ঘড়িয়াল টিকিয়ে রাখতে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে ভারত ও নেপালের মতো এ দেশে কৃত্রিম প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। বিপন্ন এসব প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। কারণ আমাদের স্বার্থেই তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

Written specially and exclusively by Dr. A. K. M. Nazrul Kabir, Associate Professor, Zoology.

Leave a Reply