ঘনিয়া ( Labeo gonius)

ঘনিয়া Cyriniformes বর্গের Cyprinidae গোত্রের একটি কার্প জাতীয় মাছ। এর ইংরেজি নাম Kuria Labeo, স্থানীয় নাম হচ্ছে ঘইন্না, গোনি, গোনিয়া, ঘাইন্না, কুরচি ইত্যাদি এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম Labeo gonius। নাজির আহমেদ ১৯৪৪ সালে লুডহিয়ানা (Ludhiana)বুডহানালার অগভীর পানিতে স্বাদুপানির শার্ক নামে পরিচিত Wallagonia attu (Bloch and Schneider) এর প্রজনন ক্ষেত্র, প্রজনন এবং পরিস্ফুটনের বিস্তারিত বর্ণনা দেন। ১৯৩২ সালে Wallagonium এর সাথে অন্যান্য কতিপয় অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন মাছের একই সাথে বিচরণ ও প্রজনন লক্ষ্য করেন। ১৯৩৩ সালে জুলাই মাসে তিনি ঘনিয়া মাছের [Labeo gonius(Hamilton,1822)] অপরিণত দশা সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণ করেন। ঐ সময় পর্যন্ত খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত কোন ভারতীয় প্রধান প্রজাতির মাছের পরিপূর্ণ জীবন ইতিহাস জানা যায়নি। তুলনামূলক অর্থনৈতিক গুরুত্ব হিসেবে কার্পের মধ্যে Labeo গণের প্রজাতিসমূহ অধিকতর গুরুত্ব বহন করে। খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে Labeo gonius এর ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। হামিদখান (১৯৩৪), প্রাসাদ ও মুখার্জী (১৯২৯) এটিকে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হিসেবে ব্যবহারযোগ্য প্রজাতি বলে উল্লেখ করেন।

জনপ্রিয় রুই মাছের সাথে Labeo gonius এর যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। Day (1877) এর মতে এ মাছ ৫ ফুটের মত লম্বা হয়। তবে ২ ফুটের অধিক দৈর্ঘ্যরে মাছ কদাচিৎ বাজারে দেখা যায়। এ মাছ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মায়ানমারের পুকুর, নদ-নদীতে পাওয়া যায়। তার মতে এ মাছটি ব্যাপকভাবে মজুদ পুকুরে চাষ করা হয়। এ মাছ ১০০-৩০০ গ্রাম হলেই বাজারে বিক্রয় করা যায়। জুভেনাইল দশাতে একুয়ারিয়াম মাছ হিসেবে এর বেশ কদর আছে। এ মাছ খেতে সুস্বাদু হওয়ায় সব ধরনের মানুষের কাছেই এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। তাই রুই,মৃগেল ও কাতলা মাছের চেয়ে এ মাছের বাজার মূল্য বেশী। বর্তমানে এ মাছটি বাংলাদেশে বিপন্ন মাছ হিসেবে IUCN Red Data Book(2000) এ স্থান পেয়েছে।

ঘনিয়া মাছের শ্রেণিবিন্যাস (Classification)

পর্বঃ Chordata
উপপর্বঃ Vertebrata
শ্রেণিঃ Actinopterygii
বর্গঃ Cypriniformes
গোত্রঃ Cyprinidae
গণঃ Labeo
প্রজাতিঃ Labeo gonius

দৈহিক বর্ণনা (Physical description)

ঘনিয়া ছোট অবস্থায় দেখতে অনেকটা রুই মাছের মতো। ভুলে অনেকেই রুই মাছের পোনা ভেবে পুকুরে তা মজুদ করে থাকে। ঘনিয়া মাছের দেহের রঙ কালচে সবুজ, উদর রুপালি। এ মাছের মুখ অধোমুখী এবং মাঝারি ধরনের চওড়া, তুন্ডে অনেক ছিদ্র থাকে। দেহের সর্বাধিক গভীরতা পৃষ্ঠপাখনার সামনে। ফুলকারন্ধ্র প্রশস্ত। এদের মুখে ছোট একজোড়া রোস্টাল এবং একজোড়া ম্যাক্সিলারি স্পর্শী রয়েছে। এ মাছের পার্শ্বলাইন অঙ্গ সম্পূর্ণ। এদের দেহ ছোট ছোট সাইক্লয়েড আঁইশ দ্বারা আবৃত। পার্শ্ব রেখা বরাবর ৭৩-৮০ টি আঁইশ বিদ্যমান। পৃষ্ঠপাখনার ওপরের কিনারা অবতল। শ্রোণীপাখনা বক্ষপাখনা অপেক্ষা সামান্য ছোট। পুচ্ছপাখনা গভীরভাবে দ্বিধাবিভক্ত। এরা সর্বোচ্চ ৬১ সেমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে এবং ওজন হতে পারে ১.৩৬ কেজি।

ভাব ও বাসস্থান(Habit and Habitat)

ঘনিয়া সাধারণত অল্প স্রোতের পানিতে বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তবে বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর ও জলাশয়ে এদের পাওয়া যায়। এরা আগাছাপূর্ণ তলদেশ পছন্দ করে না। এরা জলজ এককোষী শ্যাওলা, আদর্শ উদ্ভিদ, ক্রাস্টেসিয়া ও কীটপতঙ্গ খায় এবং পানির ওপরের স্তরের খাদ্য গ্রহণ করে থাকে।

প্রজনন (Reproduction)

ঘনিয়া মাছের প্রজনন ঋতু বেশ লম্বা। ঘনিয়া বর্ষাকালে বিশেষ করে মে মাস থেকে জুলাই মাসে নদী বা গভীর বিল থেকে উঠে এসে প্লাবন ভূমিতে প্রজনন করে। পুরুষ মাছ দৈর্ঘ্যে ১৪-২৩ সে.মি হলে এবং স্ত্রী মাছ ১৮-৩০ সে.মি হলে প্রজনন ক্ষম হয়ে থাকে। যখন এরা ওজনে ৩০০-৫০০ গ্রাম হয় তখন পূর্ণ পরিপক্কতা লাভ করে। এরা রুই মাছের ন্যায় অধিক ডিম্ব ধারন ক্ষমতা বিশিষ্ট মাছ। এদের ডিম্ব ধারন ক্ষমতা ২৪৫০০০ (৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের মাছ)-৫৪০০০০ (১.৫-১.৬ কেজি ওজনের মাছ)। এরা সাধারণত বৃষ্টির পরে ৭০০-৭৮০ ফা. উষ্ণতায় মিঠা পানিতে ডিম ছাড়ে। ডিমগুলো ভাসমান কিন্তু আঁঠাল নয়। ডিমের রঙ ঈষৎ নীল এবং ব্যাস ১ থেকে ১.৩ মিমি। ডিমগুলো পানিতে ডুবে যায় এবং পানিতে ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিমগুলো ফুলে আকারে তিনগুন বৃদ্ধি পায়। নিষেকের ২৪ ঘণ্টা পর ডিম ফোটে। ডিম ফোটার ২৪ ঘণ্টা পর শ্বসন ক্রিয়ার জন্য মুখ প্রস্ফুটিত হয় এবং ৭২ ঘণ্টা পর পোষ্টিক নালী সম্পূর্ণ তৈরি হয়। ডিম ফোটার ৭ দিন পর পোনা ৭ মি.মি দীর্ঘ হয়। বর্ষা শেষে পোনাগুলো ও বড় মাছগুলো গভীর বিলে বা নদীতে আশ্রয় নেয়।

অর্থনৈতিক গুরুত্ব

সুস্বাদু হিসেবে Labeo gonius এর যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। তাছাড়াও ঔষধি গুনাগুন থাকায় বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে এ মাছের ভূমিকা রয়েছে। স্থানীয় বাজারে অন্যান্য কার্প জাতীয় মাছ থেকে এ মাছের বাজার মূল্য বেশী। বাজারে এ মাছের কেজি প্রতি দর প্রায় ১৫০-২০০ টাকা। এ মাছ তলদেশীয় খাদ্য গ্রহণ করে বিধায় মিশ্র চাষ পদ্ধতিতে অন্যান্য তলদেশীয় মাছের বিকল্প হিসেবে এ প্রজাতিকে গন্য করা হয়। মাছের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মিটানোর জন্য এ প্রজাতি চাষ করা যেতে পারে। স্বাদু পানির জলাশয়ে মাছ চাষের ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রজাতির বৈচিত্র্যতার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই কার্প জাতীয় মাছ চাষের ক্ষেত্রে এ প্রজাতি একটি গুরুত্বপূর্ণ চাষযোগ্য মাছ।

Written specially and exclusively by Dr. A. K. M. Nazrul Kabir, Associate Professor, Zoology.

Leave a Reply